ভাষাচিত্র বুক ক্লাব আয়োজিত ‘শনিবারের গল্প’ শীর্ষক আয়োজন থেকে বাছাইকৃত গল্প নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে “দেশের বই ঈদ সাময়িকী”। আজ প্রকাশিত হলো সুপ্রিয়া দেবনাথ-এর ছোটগল্প শুক্রবার
দিনটা কেমন অবসন্ন, ক্লান্তিমাখা। রাখঢাক করে নয় কেটে যায় নির্জীব। সকালে উঠেই মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কাজের যেন শেষ নেই। নিজের জন্য কোনো বিরতি নেই। রেললাইনের মতো ছুটেই চলেছে। দীর্ঘপথ। বিরতিহীন।
শিক্ষকতা পেশায় প্রায় দশ বছর কাটিয়ে দিলো সে। এতটা বিরক্ত কখনো লাগে না। একটু সাদাসিধে সময় কাটাবে জেনেই পেশা পরিবর্তন করা হয়নি তার। তবুও যখনই অভিভাবকদের ফোন করতে হয়, ব্যাপারটা একদম ভালো লাগে না। মাথার মধ্যে একটা কেমন অস্বস্তিবোধ ঘুরে-ফিরে আসে যেমন হঠাৎ বিস্বাদ কিছু উগড়ে ফেলে দেয়ার পরে হয়। যথারীতি প্রতিমাসে তিন থেকে চারবার কাজটি করতে হয়। তখন নিজেকে মনে হয় যেন ক্রেতা আকৃষ্ট করার জন্য যত আদুরে কণ্ঠে ডাকা যায় সে যেন তাই। কোনোভাবেই তার এটা ভালো লাগে না।
দ্রুত ফোনকল শেষ করে সে। যদিও দু’একজনের সাথে কথা বলতে ভালোই লাগে। বাকিদের সঙ্গে কেতাদুরস্ত হয়েই কথা বলতে হয়। কি জানি বাপু কী বলতে কী বিপদ হয়! তাই তটস্থ হয়েই সে কথা বলে। কোনোভাবেই যেন সীমা অতিক্রম না হয়। এত আদবের প্রতিমূর্তি বিগলিত কণ্ঠে সমগ্ৰ মধুচাকের মধু একবারে ঢেলে দেয়। কত না যেন ভালোইবাসে সে। ফোন করা হয়ে গেলে হাফ ছেড়ে বাঁচে সে।
এই শহরে একাকী একটা নারী! কতটা স্ট্রাগলই না তাকে করতে হয়েছে! শুধু একটু ভদ্রভাবে বাঁচার লড়াই। মনটা ডুকরে ওঠে ঈপ্সিতার। লম্বা কোনো সফরের শেষে যে ক্লান্তিবোধ হয় ঠিক তেমন কিছু একটা। মনে মনে কত কথাদের নির্বাক যুদ্ধ হয়। থামাতে হয় তাকেই।
মননের কথা এত মনে পড়ে কেন? কত ভালোই না সে বেসেছিল তাকে। অবাক লাগে এত বছরের প্রেম, প্রতীক্ষা সব ধূলিসাৎ হলো একটা নতুন অবয়বের টানে। কী করে পারে মানুষ! কই সে তো পারে না! দুটি অবুঝ শিশুকে একা করে ফেলে রেখে কী করে কেউ যায়! মনন পেরেছিল। যখন তারা একে অপরকে ভালোবেসেছিল। মনন বলতো তোমার চোখের আকাশে আমি ধ্রুবতারা হয়ে বেঁচে থাকবো।
কত সুখের ছিল সে সময়। ভালোবেসেই দিন কেটে যেত। সুন্দর স্বপ্নের ঘোরে ,যেন বাকি সব কিছু মিথ্যা। সেই সে মানুষ যে তাকে জড়িয়ে ধরে আদরে ভরিয়ে তুলতো তাকে খুব মনে পড়ে। আকাশের ছুটে চলা মেঘের মতো এ দুঃখভার তাকে বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। এই ক্ষত যেন দুরারোগ্য কোনো ব্যাধি। ভেতর থেকে নিঃশেষ করে দেয়। সেই দাগ মাংসের ঝোলের মতো সিঁধে থাকে। কোনো কিছুতেই দূর হতে চায় না।
আজ শুক্রবার। বাকি দিনগুলো তো চলে যায় বোঝাপড়ায়। এই দিনটি শুধু তার। তাই সকাল থেকেই সে নিজের মতো করে দিনটা কাটাতে পছন্দ করে। অতীতচারী হয়ে উঠে তার মন। কত কথা মনের ক্যানভাসে রং ছড়ায়। মননের সাথে কত জায়গায় সে ঘুরতে যেত। হাতভরা কাঁচের চুড়ি মননের পছন্দ ছিল। চোখ ভরে কাজল মেখে, কপালে টিপ, খোঁপায় বড় একটা ফুল গুঁজে সে বনলতা সেন সাজতো মননের চোখে, মুক্তির অপেক্ষায়।
মননের সঙ্গে তার দেখা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে। সে খুব ভালো নাচতো। একটা অনুষ্ঠানে নাচ দেখেই মনন তাকে ভালোবেসেছিল। তারপর কতদিন আকর্ষণ করার চেষ্টা! অবশেষে তাদের পরিণয়। যদিও সবটা মননের চেষ্টায়। বিয়ের পর মননের একটু একটু বদলে যাওয়াটা ঈপ্সিতা মেনে নিয়েছিল সংসারের স্বার্থে। সব নারীই মেনে নেয়। নতুবা সংসার হয় না।
চোখের সামনে ঘুংগুরগুলো দেখে ঈপ্সিতার মন বিষাদে কেঁপে ওঠে। বিয়ের পর সে আর নাচ করতে পারেনি। মনন বলতো তার শরীর যখন ছন্দের তালে দুলে উঠে তখন নাকি তাকে অপ্সরা লাগে। নিজের স্ত্রীর এই সৌন্দর্য অন্য কেউ উপভোগ করবে তা সে পছন্দ করতো না। ঈপ্সিতাও মেনে নিয়েছিল ভালোবাসার স্বার্থেই।
প্রথম যেদিন মনন বললো সে আর সংসার চায় না ঈপ্সিতা হাজারও অনুনয় করেছিল। মনন বোঝেনি। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ আর মারধর করেও সে তৃপ্ত হয়নি। কুৎসা রটিয়েছে তার নামে। এতটা লালসা কারও মধ্যে কীভাবে তৈরি হয়? কোনোভাবেই সে আর থাকলো না!
শেষে ঈপ্সিতাও বুঝেছে জোর করে কাউকে বেঁধে রাখা যায় না। সে এখন আগের চেয়ে অনেক পরিপক্ব। সম্পর্কের জটিলতাগুলো বুঝতে শিখেছে। পুরুষের বৈচিত্র্য বুঝতে শিখেছে। পুরুষের মন কামনায় উপচে পড়ে কচি কোমল লতার আবেশে। ষাট বছরের পৌঢ়ও প্রেমিক হয় ষোড়শীর ছোঁয়ায়। শুধু নারীর বেলায় হাজার নিয়ম, শুদ্ধিকরণ পদ্ধতি। অসংখ্য পুরুষের মতো নারীই বলতে পারে না শেষ বয়সে একটা কচি পুরুষের হাত ধরবে। সমাজ তা মেনেও নিবে না অথচ নাক সিটকাবে। আর হাজারও পুরুষের একই কলঙ্ক সমাজ নিন্দা করলেও গায়ে মাখে না। নারীকে করে কোণঠাসা। এখনও সমাজ আধুনিক হতে পারেনি। নারী আর পুরুষের ক্ষেত্রে মান্ধাতার আমলের নিয়ম-কানুন।
ঈপ্সিতার গলা উপচে পড়ে বিষাদে। ক্রোধের অগ্নিচ্ছটায় তাকে কি মোহনীয়ই না লাগে। গা টা হালকা করে এলিয়ে দেয় সে সোফার কোণায়। ভাবতে ভাবতে শূন্যসম বাষ্পে মিলিয়ে যায় তার দেহ। প্রতিটা ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বিরহের রাগ বেজে ওঠে। সে যেন বিরহের গান যা মনকে বেদনায় মলিন করে তোলে। কোনো অপাঠ্য বই যা দীর্ঘদিনের অনস্পর্শতায় ধূলো ধূসরিত।
মনটা বরফের চাঁইয়ের মতো জমে আছে তার। সেখানে শুধু শীতলতা আর হাহাকার। ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে ঘড়ির দিকে তাকায়। অনেক বেজে গেছে। কত সাংসারিক কাজ বাকি! উঠতে হবে। এমন কত সময় আসে মন অনড় হয়ে যায়। কিছু করতে ভালো লাগে না। তবুও দায়িত্বের পাহাড় হাতছানি দিয়ে ডাকে।
বাচ্চাদের ডাকার সময় হয়েছে।
ভাবনাগুলো থাক এইভাবেই। জীবন তো পড়েই আছে। পরের শুক্রবার এলে না হয় আরেকটু বেশি ভেবে নিবে। তাই ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়ায়।