দেশের অন্যতম সেরা সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ভাষাচিত্র। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, নতুনত্ব আর আদর্শিক ভাবনা থেকে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রাপথ চলমান। সামাজিক যোগাযোগ্যমাধ্যম ফেসবুকে ‘ভাষাচিত্র বুক ক্লাব’-নামের একটি গ্রুপের মাধ্যমে সারাদেশের বইপ্রেমী পাঠকদের সঙ্গে একটি যোগসূত্র স্থাপনের অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
এই গ্রুপে পাঠকদের নিয়ে একটি ভিন্নধর্মী আয়োজন পাঠক প্রোফাইল। পাঠকগণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজের সম্পর্কে গ্রুপে পোস্ট দেন। নির্বাচিত পোস্টগুলো আমরা দেশের বই পোর্টাল-এ প্রকাশ করি। আজ প্রকাশিত প্রকাশিত হলো নাহিদ বেগম লাকী’র প্রোফাইল
আমি নাহিদ বেগম লাকী। ১৯৬৭ সালের পহেলা ডিসেম্বর মধুমতীর তীরে গোপালগঞ্জ জেলা শহরে নানার কামারপট্টির বাসায় জন্ম আমার! সাত ভাই আর পাঁচ বোনের বিশাল পরিবারে আমার স্থান তিন নম্বরে। আমার প্রথম বই পড়ার স্মৃতি এখনও স্পষ্ট মনে আছে। আমি তখন ২য় শ্রেণির ছাত্রী। গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি! বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশোনা করতেন হালিম স্যার। উনি তখন সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজের স্নাতক শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। আমি উনার বাংলা বই থেকে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সোনার তরী কবিতাটি বানান করে করে পড়ে নিয়েছিলাম! পড়ার পরে কবিতাটি এত ভালো লেগে গিয়েছিল যে, পরবর্তী কয়েক দিনে আমি তার বেশ খানিকটা মুখস্ত করে ফেলেছিলাম! তারপর ঐ ছোট্টবেলাতেই কবিতা পড়ার এক নেশায় পেয়ে যায়! একে একে কবর. আসমানী ও পল্লীস্মৃতিসহ বেশকিছু কবিতা আমি মুখস্থ করে ফেলেছিলাম! আবৃত্তিটা অত ভালো না পারলেও স্কুলের প্রতি শনিবারের অনুষ্ঠানে একটা করে কবিতা আবৃত্তি আমার জন্য রুটিন হয়ে গিয়েছিল!
বাড়িতে আমার দাদার মস্তবড় একটা বই ভর্তি ট্রাঙ্ক ছিল; কাচারি ঘরের যে রুমটায় উনি থাকতেন। কলেজ যাওয়ার সময় বাইরে থেকে উনি তা তালা দিয়ে রাখতেন! এক বিশেষ উপায়ে কেবলমাত্র আমিই তা খুলতে পারতাম! দাদা কলেজ থেকে না ফেরা অব্দি ঐ বদ্ধ ঘরে বইয়ের সাথে একাকার হয়ে মিশে থাকতাম! হাতে-নাতে ধরা না পড়লেও আমার বিশ্বাস দাদা সব বুঝতে পারতেন আমার মাথায় বইয়ের ভূত আছে জেনে কিচ্ছু বলেননি কোনোদিন! একবার আমি উনার প্র্যাকটিক্যাল খাতায় একটা নাটকের কিছু অংশ লিখে ফেলেছিলাম! কিছুই বলেননি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন তুই কি নাট্যকার হবি? উত্তর দিয়েছিলাম হতেও তো পারি! এই এক কথায় সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন! যদিও সে প্রতিশ্রুতি আজ মূল্যহীন! আমার দাদা অনেক বড়ো একজন মানুষ! সাংবাদিকতা করেন সিনেমা বানান!
আমি আমার বড় মামার বড়ো ছেলে আর মেজো খালার মেজো ছেলে এই তিন ভাইবোন এক ক্লাসে পড়তাম। মামাতো ভাইটা ঢাকার মহাখালীর আইপিএইচ স্কুলে আর আমরা দু’জন গোপালগঞ্জের মডেল স্কুল আর বীণাপানি স্কুলে পড়াশোনা করতাম! তিনজন ছিলাম হরিহর আত্মা! যে কোনো ছুটি-ছাটাতেই ওরা আমাদের বাড়িতে আসতো! মাছ ধরা, শাপলা তোলাসহ সবকিছুতেই তুমুল হৈচৈ হতো! প্রকৃতির অনেক কাছাকাছি একটা চমৎকার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে আমাদের!
গিয়াস ভাই একটু বেশি ই বইপোকা ছিল! ঢাকা থেকে আসার সময় ও অনেক বই আর পত্রিকা নিয়ে আসতো! অনেক রাত অব্দি বই পড়তো! ও র কাছে ও’র পড়ে ফেলা বইয়ের গল্প শুনতাম! ওর বলার গুনে সব চরিত্রগুলো আমার কাছে জীবন্ত হয়ে উঠতো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস পূর্বপশ্চিম ওকে পড়তে দেখে পড়ার জন্য চেয়েছিলাম একবার! দেয়নি। বলেছিল আমি ধার করে এনেছি দিতে পারবো না। তুই অন্য কারো থেকে এনে পড়িস। কয়েকদিনের মধ্যে জিদ করেই পড়ে ফেলেছিলাম বইটা!
এ যাবত যত বই পড়েছি তারমধ্যে সমরেশ মজুমদারের “সাতকাহন ” আমার ভালোলাগা.ভালোবাসা আর ভীষণ পছন্দের বই! বইটা পড়বার পর কতবার দীপাবলি হতে চেয়েছি! আজও চাইছি হয়তো যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিনই চাইবো!
পরীক্ষার সময়ে ক্লাসের বইয়ের মধ্যে গল্পের বই লুকিয়ে পড়ার জন্য মায়ের কাছে বকুনি খেয়েছি অনেকবার!
মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হলো! সংসার ধর্মের পাশাপাশি চাকরি ধর্ম পালন করছি! ব্যাক্তিগত জীবনে দুই ছেলের মা হয়েছি! এত এত কিছুর পরেও বইয়ের জন্য একটা ভালোবাসা একটা টান আজও বুকের মধ্যে লালন করে চলেছি! এ আমার অন্যরকম ভালোবাসা অন্যরকম অনুভূতি! আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ! ভবিষ্যতে আমার ব্যাক্তিগত সংগ্রহকে আরও বাড়াতে চাই। একটা সুন্দর লাইব্রেরি থাকবে যেখানে থরে থরে সাজানো থাকবে আমার পছন্দের বইগুলো! আমার স্বপ্ন সাধনা আর ভালোবাসা নিয়ে বাকি জীবনটা আমি এভাবেই কাটাতে চাই!
সবশেষে ভাষাচিত্রকে এজন্য ধন্যবাদ জানাই যে, তাদের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েই আজ এ লেখাটা লিখতে পারলাম! আসলে ভাষাচিত্রের স্বার্থকতাটা এখানেই!
দেশের বই পোর্টালে লেখা ও খবর পাঠাবার ঠিকানা : desherboi@gmail.com