ভাষাচিত্র বুক ক্লাব আয়োজিত ‘শনিবারের গল্প’ শীর্ষক আয়োজন থেকে বাছাইকৃত গল্প নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছে “দেশের বই ঈদ সাময়িকী”। আজ প্রকাশিত হলো আশরাফ-উল-আলম-এর ছোটগল্প ফুলের ঈদ
চৌরাস্তার পশ্চিম কোণে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে এসে দাঁড়ালেন রহমান সাহেব। সুন্দর ফুল ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া গাছে। আশেপাশে ভবন বা অন্য কোনো স্থাপনা না থাকায় গাছের তলায় খুব আরাম বোধ হচ্ছে রহমান সাহেবের। প্রচণ্ড এই গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা থেকে রেহাই পেতে এই গাছতলাটা দারুণ পছন্দ তার।
প্রতিদিন অফিস ছুটি শেষে অর্ধেক পথ হেঁটে আসেন রহমান সাহেব। গাছতলায় এসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে তারপর বাসে ওঠেন। এভাবে বাসের অর্ধেক ভাড়া বাঁচান তিনি। রোজকার মতো বসে পড়লেন গাছতলায়।
বসে বসে তিনি চৌরাস্তার দৃশ্য দেখেন। চৌরাস্তায় কেউ ভিক্ষা করে। কেউ ফেরি করে নানা ধরনের পণ্য বিক্রি করে। কেউ ফুল বিক্রি করে। প্রতিদিনের একই দৃশ্য। দেখতে ভালোই লাগে তার।
পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়েকে ফুল বিক্রি করতে দেখে বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে রহমান সাহেবের। গাড়ির জানালায়, রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই শিশুটি। বেশিরভাগ যাত্রী ধমক দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। হঠাৎ হঠাৎ দু’একজন ফুল কেনে।
শিশুটি রহমান সাহেবের কাছে বসে।
‘স্যার একটা ফুলের তোড়া নেবেন। আপনারা না নিলে খাইবো কি কন?’
বিড়বিড় করে বলে শিশুটি। অনেক মায়া লাগে রহমান সাহেবের।
‘তোমার নাম কী?’
‘ফুল। ফুল আমার নাম।’
‘সুন্দর নামতো! কে রেখেছে নামটা?’
‘মা রাখছিলো হুনছি।’
‘মা কোথায়?’
‘জানি না।’
‘জানো না কেন?’
‘সে অনেক কথা।’
‘একটু বলো।’
‘বাপে আমারে আর আমার মায়রে ফেলাইয়া আরেকজনরে বিয়া কইরা ভাগছিলো। পরে মায়ও আরেকটা বিয়া করে। ব্যাটায় আমারে তাগো সাথে রাখে না। পরে খালায় আমারে লইয়া আইছে।’
‘কোথায় থাকো?’
‘ওই বস্তিতে। খালার আরও তিনডা পোলাপান। মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কামকাজ করে। নিজেরাই খাইতে পারে না। আমারে খাওয়াবে কি? তাই ফুল বেচি। ফুলের আড়ত থেকে ফুল টোকাইয়া আনি।’
‘কয় টাকা পাও?’
‘ঠিক নাই। মাঝে মইধ্যে ৩০/৪০ টাহা অয়। খালার হাতে দেই। খালা তিনবেলা খাওন দ্যায়। কিন্তু পোশাক-আশাক দ্যায় না। দাম বেশি তাই। বইনেগের ছেঁড়া কাপড়-চোপড় আমারে পইরতে দ্যায়।’
রহমান সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে যায়। এমন ফুটফুটে চেহারার এই ফুল। কেন গরীবের ঘরে জন্ম নিলো? রহমান সাহেব জানেন এই প্রশ্নের কোনো ব্যাখ্যা নেই। তারপরও ব্যাখ্যা খোঁজেন তিনি।
রহমান সাহেব ফুলকে জিজ্ঞেস করেন, ঈদে কেউ জামা দেয় না?
‘কেডায় দিবো? আমনেরা তো ফুলই কেনেন না। ফুল বেইচা এই ঈদে জামা কিনতে চাইছিলাম। কিন্তু বেচাবিক্রি নাই। দুইদিন পরে ঈদ। আর কিনমু কবে?’
রহমান সাহেব ফুল না নিয়ে পাঁচ টাকার একটা নতুন নোট ফুলের হাতে দেন। তারপর মন খারাপ করে বাসে উঠে বাসায় চলে যান। ঈদের ছুটির আগে অফিস শেষে রহমান সাহেব গাছতলায় এসে বসেন। তিনি ফুলকে দেখেন না। ফুল নেই। কী হলো ফুলের!
রহমান সাহেব হাঁটতে হাঁটতে একটু দূরের ঐ বস্তিতে গিয়ে পৌঁছান। ফুলকে খোঁজেন। একজনকে জিজ্ঞেস করলেই ফুলের খালার ঘর দেখিয়ে দেয়।
ফুল ফুল করে ডাকতে ডাকতে রহমান সাহেব ওই ঘরে ঢোকেন। ফুলের জ্বর। মাথায় হাত দেন রহমান সাহেব। ফুল তাকায়। রহমান সাহেবকে দেখে চমকে ওঠে ফুল। উঠে বসে। ‘ছাড় আপনি এই বস্তিতে আইছেন?’
‘কেন আসতে নেই নাকি?’
‘কেউ আসে না তো।’
‘তোমাকে দেখতে এসেছি। খুশি হওনি?’
‘খুব খুশি। আমার জ্বর ভালা অইয়া গেছে দেহেন।’
রহমান সাহেব ব্যাগ থেকে একটা লাল জামা আর একটা লাল পায়জামা বের করে দেন। ফুল ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। খুশিতে ফুলের চোখে জল চলে আসে।